প্রকাশিত: Sun, Mar 5, 2023 4:30 PM
আপডেট: Thu, Jun 26, 2025 3:26 AM

শাহরুখ খানের ‘পাঠান’ ও আমাদের চলচ্চিত্র

অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল) : এবারের ভারত সফরের আইটিনেরারিতে প্রথমে কলকাতা ছিল না। পরিকল্পনা ছিল গৌহাটিতে নর্থ ইস্ট গ্যাস্ট্রো কনফারেন্সে লেকচার দিয়েই ফিরে আসব। কনফারেন্সটা দক্ষিণ-পূর্ব ভারতের সব চাইতে পুরনো আর সেই সঙ্গে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ লিভার মিটিং। উত্তর-পূর্ব ভারত থেকে তো বটেই, সাড়া ভারত থেকেই লিভারের রথী-মহারথীরা এই কনফারেন্সে যোগ দেন। কাজেই এহেন নর্থ ইস্ট গ্যাস্ট্রো কনফারেন্সের আয়োজকরা যদি আমাকে হোটেল বুক করে, রিটার্ন বিমান টিকেট পাঠিয়ে বলে যে, তাদের সম্মেলনে আমাকে ন্যাসভ্যাক নিয়ে একটা লেকচার দিতেই হবে, তখন তা অগ্রাহ্য করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।

আর হেপাটাইটিস বি’র এই নতুন ওষুধটি, অর্থাৎ, ন্যাসভ্যাকের সহ-উদ্ভাবক হিসেবে যেহেতু বাংলাদেশ আর আমার নামটা চলেই আসে, কাজেই সুযোগ পেলেই ন্যাসভ্যাকের উপর লেকচার দেওয়া হাতছাড়া করতে নারাজ। সব মিলিয়ে তাই এবারের গৌহাটি যাওয়া। কলকাতাটা ঢুকে পড়ল হঠাৎই। ঢাকার সঙ্গে গৌহাটির সরাসরি বিমান যোগাযোগ নেই বলে যাওয়ার রুটটা বেছে নিয়েছিলাম কলকাতা হয়ে। তবে কলকাতায় রাত কাটানোর বুদ্ধিটা শুরুতে ছিল না। রথ দেখার পাশাপাশি কলা বেচার সুযোগ চলে আসায় অর্থাৎ, কলকাতায় দুটো রিসার্চ কোলাবোরেশন মিটিং পড়ে যাওয়ায়, রাতে থেকে যেতে মনস্থ করলাম।

ধান ভানতে শিবের এই গীত গাওয়ার কারণটা এই যে, ওই রাতে যদি কলকাতায় না থাকা হতো, তাহলে কিন্তু অন্তত আর যাই হোক এই লেখাটি লেখা হয়ে উঠতো না। কলকাতায় যেহেতু রাতে থাকাই হচ্ছে, কাজেই রাতটাকে কাজে লাগাতে সিদ্ধান্ত হলো ‘পাঠান’ ছবিটি দেখার। হালের এই জনপ্রিয় হিন্দি সিনেমা প্রথম দুই সপ্তাহেই নাকি হাজার কোটি রুপির উপর ঘরে তুলেছে। সিনেমার কেন্দ্রীয় চরিত্রে আছেন শাহরুখ খান, দীপিকা পাড়ুকোনের সঙ্গে সালমান খানের বিশেষ এপিয়ারেন্স। তাছাড়া শেষ কবে যে ভারতে হলে বসে সিনেমা দেখেছি, ঠিকঠাকমতো মনেই করতে পারছিলাম না। কদিন আগে কলকাতায় সর্বশেষ সফরেও উদ্যোগ নিয়েছিলাম মুভিথিয়েটারমুখী হওয়ার। নানা কারণে সেবার আর সেটা হয়ে ওঠেনি। কাজেই এবার আর প্রস্তাবটা মাটিতে পড়তে দিলাম না। কলকাতার নিউটাউনের সিটি সেন্টার টুতে আইনক্স মুভি থিয়েটারে ঢুকতেই মনটা ভালো হয়ে গেল। লেট নাইট শোতেও দর্শকের ভালোই সমাগম। সফট ড্রিংক আর পপকর্নের প্যাকেট হাতে সবার টানটান প্রস্তুতি দারুণ একটা মুভি দেখার।

দেখতেই ছবি দেখার আগেই মনটা ভালো হয়ে যায়। সঙ্গে একটু নস্টালজিয়া আর হৃদয়টা কিছুটা ভারে ভারাক্রান্তও বটে। মনে পড়ছিল নিজের ছোট বেলায় আনন্দ, ছন্দ, অভিসার আর জোনাকীতে আব্বা-আম্মা আর ছোট বোনকে সঙ্গে নিয়ে এমনি কতই তো সিনেমা দেখেছি। মিমি চকলেটের প্যাকেট হাতে, চিপসের প্যাকেট বগলদাবা করে হলে ঢোকা, সিনেমার শুরুতে জাতীয় সংগীত বাজতে শুরু করলে লাফিয়ে দাঁড়িয়ে সম্মান জানানো, সিনেমা তা সে যাই হোক না কেন, ইন্টারভেলের সময় আবারও আরেক রাউন্ড চিপস বা চানাচুর, সে যুগে সেসব ছিল দারুণ এন্টারটেইনমেন্ট। এতটাই যে পঞ্চাশ পেরনো এই আমাকেও তা আইনক্সে বসে নস্টালজিক করে দেয়।

কবে থেকে যে হারিয়ে গেল সেসব, এখন ঠিকঠাকমতো মনেও করতে পারি না। মুক্তিযুদ্ধের পরপর ছিল ‘ওরা এগারো জন’, ‘আবার তোরা মানুষ হ’-এর জমানা। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর সে জায়গায় এলো ‘আবে হায়াৎ’-এর জোয়ার। বাঙালীর বাঙালিয়ানা আর মুক্তিযুদ্ধ চলে গেল সাইড লাইনে আর সেই জায়গাটা কিভাবে যেন দখল করে নিল ‘রাজা-রানী, ‘নাগ-নাগিনী’ ইত্যাদি। এ সময়টায় যে ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ কিংবা ‘সুজন সখি’ আর ‘সীমানা পেরিয়ে’-এর মতো ছবিগুলো আসেনি, তা নয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এ সব ছবিতে বাংলার সমাজ আর পারিপার্শ্বিকতা তুলে আনার প্রয়াস থাকলেও, বাঙালির সবচেয়ে গৌরবজনক যে অর্জন, আমাদের সেই মুক্তিযুদ্ধ ছিল নির্বাসনে।

ক্রমেই ‘বেদের মেয়ে জোৎস্না’রা এসে ঢালিউডে সৃষ্টিশীলতার যেটুকু ধারা বহমান ছিল, তাকেও এক সময় গ্রাস করে নিল। এরপর ‘মুক্তির গান’, ‘গেরিলা’ আর হালের ‘জেকে ১৯৭১’ আর ‘হাওয়া’-এর মতো কোরামিন ইনজেকশনগুলো দিয়ে ঢাকাই চলচ্চিত্রকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা মাঝে-সাঝেই করা হলেও তাতে কাজ আর খুব একটা হয়নি। তেমন একটা কাজে আসেনি চলচ্চিত্র তৈরিতে সরকারি অনুদান আর সিনেমা হল মালিকদের জন্য সরকারি প্রণোদনাও।

ঢালিউড আইসিইউ আর এইচডিইউ-এর মধ্যে শুধু আসা-যাওয়াই করেছে। হালে তথ্যমন্ত্রী মহোদয় ভারতীয় চলচ্চিত্র আমদানির কথা বলছেন। বলছেন এর মাধ্যমে মানুষকে আবার হলমুখী করার সম্ভাবনার কথাও। প্রথম দিকে মন্ত্রী মহোদয়ের এমনি ধরনের যুক্তিতে খুব একটা যৌক্তিকতা খুঁজে পাইনি। কিন্তু সে রাতে কলকাতার মুভি থিয়েটারে লেটনাইট শোতে ‘পাঠান’ দেখতে বসে, ছবিটা শুরুর আগেই কেন যেন মনে হলো মন্ত্রীর কথার যৌক্তিকতা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। এদেশে একটা সময় ছিল যখন আমদানি করা ভারতীয় সিনেমা হলে বসে দেখা যেত আর আমার ধারণা সেটাই ছিল বাংলার চলচ্চিত্রের স্বর্ণযুগ। তারপর একটা সময় দেশীয় সিনেমাকে প্রতিযোগিতার হাত থেকে রক্ষার যুক্তি দেখিয়ে বন্ধ করা হয়েছিল ভারতীয় সিনেমার আমদানি।

হলিউডের জন্য ঢাকার হলগুলোর দরজা খোলা থাকলেও, ঢাকায় মানসম্পন্ন হলিউডের ছবি রিলিজ হতো কালে-ভদ্রে। বরং ঢাকার হলগুলোতে চালানো হতো ‘এন্টার দ্য ড্রাগন, এক্সিট দ্য টাইগার’ আর ‘স্নেক ইন দ্য মাংকিজ শ্যাডো’ জাতীয় বস্তা পচা কিছু হলিউডি-চীনা খিচুড়ি, আর সঙ্গে এক টিকেটে দুই ছবির নামে চলতো আনসেনসরড পর্নো ছবির প্রদর্শনী। ঢাকা কলেজে ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র হিসেবে ক্লাস ‘বাং’ মেরে একটি টিকিট কেটে এমনি দুটো ছবি দেখার অভিজ্ঞতা, সে জমানার আরও অনেকের মতো আমার ঝুলিতেও কম নেই।

আসলে সংরক্ষণের কথা বলে ঢালিউডকে ধ্বংসেরই পাঁয়তারা ছিল এ ধরনের সংরক্ষণবাদী নীতি। প্রতিযোগিতা ছাড়া গুণগতমান কখনই নিশ্চিত করা যায় না। সে দিন যারা বাংলা সিনেমাকে বাঁচানোর ধোঁয়া তুলেছিল, তারা আসলে প্রতিযোগিতাহীন একটি আবহে বাংলা সিনেমাকে পঙ্কিল গর্তে ঠেলে দিয়ে, বাঙালি মধ্যবিত্তকে পাকাপাকিভাবে সিনেমা হল থেকে খেদিয়ে দেওয়ার প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল মাত্র। কারণ, সিনেমার যে কি শক্তি, এসব ‘বাহাদুর’ আর ‘আবেহায়াৎ’ প্রবক্তারা তা  ভালোই জানতো। যা আবার অনেক দিন পর উপলব্ধি করলাম ‘পাঠান’ দেখে। আরেকটি বড় উদাহরণ বোধ করি বাংলা নাটক। এক সময় মঞ্চে বাংলা নাটকের যে জয়জয়কার ছিল, আজ সেই জৌলুস যে কিছুটা হলেও কম এটি যেমন সত্যি, তেমনি এর অপর পিঠের সত্যিটা এই যে, এখনো ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া আর ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মগুলোর কল্যাণে বাংলা নাটকের বিকশিত হওয়ার আরেকটা ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। সেখানে কিন্তু প্রতিযোগিতাও আছে। 

সেখানে বাংলা নাটকের প্রতিদ্বন্দ্বী ‘সুলতান সুলেমান’ থেকে শুরু করে ‘কিসি সাস ভি কাভি বাহু থি’ পর্যন্ত অনেক কিছুই। আর সেই প্রতিযোগিতাই যে আজ বাংলা নাটককে কোথায় নিয়ে গেছে তার একটা মহড়া দেখলাম এবারই ফিরতি পথে কলকাতার বিমানবন্দরে। একই ফ্লাইটে ঢাকায় ফিরছিলাম আমি আর চঞ্চল চৌধুরী। মাস্কে মুখ ঢাকা সত্ত্বেও তাকে নিয়ে বিমানবন্দরেই কলকাতার বাঙালিদের আগ্রহ আর সঙ্গে তাদের মুখে বাংলা নাটকের প্রশংসা আমার এই বিশ^াসকেই আরও পোক্ত করেছে। ‘পাঠান’ দেখার পর হোটেলে ফিরতি পথে আরেক ধরনের উপলব্ধিতে আচ্ছন্ন হলাম। সিনেমাটা আপাতদৃষ্টিতে হলিউডি কায়দায় নির্মিত একটা এ্যাকশন মুভি, যার অনেকটাই এনিমেশনের মাধ্যমে সৃষ্টি করা হয়েছে। এনিমেশনের কাজ নিঃসন্দেহে বিশ্বমানের এবং এ্যাকশন মুভি লাভারদের জন্য ছবিটিও নিঃসন্দেহে উপাদেয়। সত্যি বলতে কি আমিও ‘পাঠান’ উপভোগই করেছি, যদিও চলচ্চিত্র বোদ্ধারা অনেকেই আমার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করতেই পারেন।

আমিও স্বীকার করে নিচ্ছি যে, ‘পাঠান’-এর ‘পথের পাঁচালী’ টাইপের কোনো আবেদন অতি অবশ্যই নেই। তবে এর আবেদনটা অন্যখানে। বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতি ভারত যখন কোভিড-উত্তর পৃথিবীতে বিশ্বের নিয়ন্ত্রকদের কাতারে নিজেকে নিয়ে যেতে চাইছে, তখন ভারতের সভাপতিত্বে জি-২০-এর সম্মেলনের বছরে এমন একটি দারুণ হিট ছবি ভারতীয়দের যে শুধু জাতীয়তাবোধেই দারুণভাবে উজ্জীবিত করবে তা নয়, তারা এখন বিশ্বাস করতে শুরু করবে যে, সিআইএ, কেজিবি আর এমআই-৯-এর মতো তাদেরও ‘র’ আছে। ওদের যদি থাকতে পারে র‌্যাম্বো কিংবা জেমস বন্ড, তবে ভারতের পাঠানও কাঁপাতে পারে বিশ্ব। হল থেকে বের হওয়ার পথে প্রতিটি ভারতীয় দর্শকের চোখে সন্তুষ্টির পাশাপাশি সেই আত্মবিশ্বাসটুকু দেখেছি।

ফেসবুকে আমার ‘পাঠান’ দর্শনের স্ট্যাটাসটি দেখে অনেকেই জানতে চেয়েছেনÑছবিটি কেমন, কেমন লাগল ইত্যকার নানা বিষয়। আমার কাছে উত্তরটা এতটা সোজা মনে হয়নি। আমি কোনো সিনেমাবোদ্ধা বা এ বিষয়ে কোনো বিশেষজ্ঞ নই। তারপরও ছোট্ট নামের বড় বাজেটের এই ছটিটি দেখে এটুকু বুঝেছি যে, ছবিটি দেখার পর আমার যে অনুভূতি আর উপলব্ধি তার প্রকাশ সারমর্মে নয়, ভাবসম্প্রসারণেই শ্রেয়। এক ‘পাঠান’-এর আড়াই ঘণ্টায় আমার হয়েছে কয়েক দশকের পরিক্রমা। আমি এখন অধীর আগ্রহে ঢালিউডের ‘ঢাকাইয়া’ অথবা ‘সিলেটি’-র প্রত্যাশায় সময় গুনছি। 

 লেখক: ডিভিশন প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও  সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ